জাতীয়

এখনো অধরা তিন ডাকাত, উদ্ধার বাকি আরও ৩ কোটি

  জাগো কণ্ঠ ডেস্ক ৪ মে ২০২৩ , ৪:৪৭ অপরাহ্ণ

রাজধানীর উত্তরার তুরাগ এলাকায় ডাচ বাংলা ব্যাংক লিমিটেডের সোয়া ১১ কোটি ছিনতাইয়ের ঘটনায় এখন পর্যন্ত ১৩ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তাদের মধ্যে ১২ জনই আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে আট কোটি ১০ লাখ টাকা এবং ডাকাতির ২০ লাখ টাকায় কেনা একটি গাড়িও।

তদন্ত সংশ্লিষ্ট গোয়েন্দা পুলিশের কর্মকর্তারা বলছেন, ঘটনার এক বছর আগে ডাকাতির পরিকল্পনা হয় উত্তরার একটি চায়ের দোকানে বসে। ডাকাতির কাজে ব্যবহার করা হয় ভাড়াটে ডাকাত দল। মূল পরিকল্পনাকারীদের মধ্যে প্রধান ছিলেন গোপালগঞ্জের ডিবি পরিচয়ে পেশাদার ডাকাত আকাশ আহমেদ বাবলু, মানি প্ল্যান্ট লিংক প্রাইভেট লিমিটেডের সাবেক চালক সোহেল রানা এবং আকাশের পূর্ব পরিচিত গোপালগঞ্জ সদরের হাবিবুর রহমান হাবিব।

তিনজনসহ মোট ১৩ জন গ্রেপ্তার হলেও এখনো অধরা ৩ ডাকাত। উদ্ধার করা যায়নি প্রায় ৩ কোটি টাকা। বাকি আসামি ও টাকা উদ্ধারের পর চাঞ্চল্যকর মামলার অভিযোগপত্র দাখিল করা হবে।

গত ৯ মার্চ সকালে রাজধানীর উত্তরার তুরাগ এলাকায় ডাচ্ বাংলা ব্যাংকের বুথে পৌঁছে দেওয়ার পথে মানি প্ল্যান্ট লিংক প্রাইভেট লিমিটেডের ১১ কোটি ২৫ লাখ টাকা ডাকাতি হয়। ঘটনার পরপরই ঘটনাস্থল পরিদর্শন ও গোয়েন্দা নজরদারি শুরু করেন ডিএমপির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। ওইদিন বিকেলে তুরাগ থানায় মামলা হয়।

ডাকাতির ঘটনা সম্পর্কে গোয়েন্দা পুলিশের মিরপুর জোনাল টিমের এডিসি সাইফুল ইসলাম সাঈফ বলেন, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে খিলক্ষেত এলাকায় একটি কালো রঙয়ের মাইক্রোবাস উদ্ধার করি। ওই গাড়িতে থাকা তিনটি ট্রাঙ্ক উদ্ধার করা হয়। যা গণনা করে ডাকাতির ৩ কোটি ৮৯ লাখ ৫০ হাজার টাকা মিলেছে।

গাড়ির চালক আকাশ মাদবর (২৫) জানান, আগের রাতে সিলেট যাবার কথা বলে কালো হাইস গাড়ি ভাড়া করেন মাসুদ নামে পরিচয় দেওয়া ব্যক্তি। ৯ মার্চ সকালে কুর্মিটোলা হাসপাতালের সামনে থেকে ৮/১০ জন মিলে চালককে বেঁধে পায়ের কাছে ফেলে বিমানবন্দর এলাকায় ইউটার্ন করে মিরপুর ডিওএইচএস এলাকায় যায়। সেখানে তারা মানি প্ল্যান্টের গাড়িতে টাকা ডাকাতি করে।

বেঁধে রাখা আকাশ মাতবরকে উত্তরা জসীম উদ্দীন এলাকায় এসে নেমে সে তার ছোট ভাই সাগর মাতবরকে ডাকে। তার হাতে একটি ব্যাগ দেয়।

এডিসি সাইফ বলেন, ডাকাতদের ফেলে যাওয়া টাকা নিয়ে ফিরে যায় আকাশ ও সাগর মাতবর। তাদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে দক্ষিণখানের একটি বাসার বাথরুমের ফলস ছাদ থেকে সাত লাখ টাকা উদ্ধার করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদে তারা জানায়, ডাকাত দলের সঙ্গে জড়িত নন তারা। তখন প্রশ্ন উঠে তবে ডাকাত দলের সদস্য কারা?

আমরা অসংখ্য সিসি টিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করে জানতে পারি, বনানী থেকে হেঁটে হেঁটে কুর্মিটোলা এসেছিল ডাকাতরা। সানোয়ার হাসান নামে ডাকাত দলের এক সদস্যকে প্রথম শনাক্ত করা হয়। তার বনানীর বাসায় অভিযান পরিচালনা করে উদ্ধার করা হয় এক কোটি ১৪ লাখ ৫১ হাজার ৫০০ টাকা। তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে বনানী সুপার মার্কেট থেকে গ্রেপ্তার করা হয় ইমন ওরফে মিলনকে। তার জোয়ার সাহারার বাসা থেকে উদ্ধার করা হয় ৩২ লাখ ৪৭ হা্জার ৫০০ টাকা। একই দিনে সুনামগঞ্জ থেকে আরও চারজনকে গ্রেপ্তার করা হয়।

গোয়েন্দা মিরপুর বিভাগের দাবি, বদরুল আলম, মিজানুর রহমান, সনাই মিয়া ও এনামুল হক বাদশা নামে গ্রেপ্তার চারজনের কাছ থেকে একটি টাকাও উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। তারা মূলত ভাড়াটিয়া হিসেবে এসেছিলেন। টাকা ভাগ বাটোয়ারার আগেই তারা ধরা পড়েন।

১৩ মার্চ সানোয়ার ও বদরুলের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে গুলশান কড়াইল বস্তির বউ বাজারে অভিযান চালিয়ে গ্রেপ্তার করা হয় ডাকাতিতে জড়িত আরেক সদস্য হৃদয়কে। উদ্ধার করা হয় ৪৮ লাখ ৭ হাজার টাকা। তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে ১০ লাখ টাকাসহ নেত্রকোণা থেকে গ্রেপ্তার করা হয় মিলন মিয়াকে।

গ্রেপ্তারদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে স্পষ্ট হয় ডাচ-বাংলা ব্যাংকের টাকা ছিনতাইয়ে পরিকল্পনাকারী আকাশ, সোহেল রানা ও হাবিবের নাম। ১৪ মার্চ খুলনা সিঅ্যান্ডবি কলোনী থেকে গ্রেপ্তার করা হয় আকাশকে। আকাশের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে ডাকাতির টাকায় কেনা একটি গাড়ি জব্দ করা হয়। এরপর ১৭ মার্চ সাভারের হেমায়েতপুরে অভিযান পরিচালনা করে গ্রেপ্তার করা হয় সোহেল রানাকে। সেই বাসা থেকে উদ্ধার করা হয় লুট করা ৮৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা। এরপর গত ৩০ মার্চ গোপালগঞ্জের কাজলীয়ায় অভিযান পরিচালনা করে ডাকাত দলের অধরা সদস্য হাবিবকে গ্রেপ্তার করা হয়। লুকিয়ে রাখা মোট ১১ লাখ টাকা উদ্ধার করা হয়। তবে এখনো অধরা ডাকাত দলের সদস্য জনি, মোস্তফা ও হিমন।

ডাকাতির পরিকল্পনাকারী আকাশ
তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, ডাচ বাংলা ব্যাংক লিমিটেডের সোয়া ১১ কোটি ছিনতাইয়ের মূল পরিকল্পনাকারী মো. আকাশ আহমেদ বাবলু। তার বাড়ি গোপালগঞ্জ সদরে। ডিবি পুলিশের ছদ্মবেশে ডাকাতি করা তার পেশা। উত্তরায় চায়ের দোকানে বসে ডাচ বাংলা ব্যাংকের টাকা বহনকারী মানি প্ল্যান্ট লিংক প্রা. লি. এর সাবেক চালক সোহেল রানার সঙ্গে পরিচয়। সেই ‍সূত্রে কথাবার্তা হয়। সোহেল রানাই আকাশকে মানি প্ল্যান্টের গাড়ি থেকে টাকা ডাকাতির পরিকল্পনা কৌশলের কথা জানান।

মানি প্ল্যান্টের চাকরিচ্যুত চালক সোহেল রানা পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে জানান, তার বাড়ি বরিশালের গৌরনদী উপজেলায়। তিনি ও তার স্ত্রী একটি হত্যা মামলার আসামি। তিনি জানতেন মানি প্ল্যান্টের কোন গাড়ি লক্করঝক্কর, কোন গাড়িতে কোনো গানম্যান থাকে না। উত্তরা হাউজ বিল্ডিং এলাকায় আকাশের সঙ্গে পরিচয় হয়। কৌশলে জেনে নেয় কীভাবে মানি প্ল্যান্টের গাড়িতে ডাকাতি করা যায়।

অপর গ্রেপ্তার হাবিবুর রহমান হাবিব পেশায় গাড়ি চালক। গুলশানের একটি বাসায় চালক হিসেবে চাকরিরত অবস্থায় একজন গৃহকর্মী খুনে মামলায় তিনি ৩০ বছরের সাজাপ্রাপ্ত আসামি। আট বছর জেল খেটে বেরিয়ে তিনি আকাশের কথায় আবারও ডাকাতির কাজে জড়ান।

আকাশ সোহেল ও হাবিবই ছিলেন মূল পরিকল্পনাকারী। বনানীর একটি স্পা সেন্টারে যাতায়াত ছিল আকাশের। সেই সুবাদে পরিচয় হয় দালাল ইমন ওরফে মিলনের সঙ্গে। ডাকাতির পরিকল্পনা শুনে লোক সংগ্রহসহ সার্বিক সহযোগিতার আশ্বাস দেন।

গ্রেপ্তার হওয়া সানোয়ার হোসেন বনানী সুপার মার্কেট থেকে চারটি মোবাইল ফোন সেট ও সিম কেনেন। প্রথমে চারজন চাওয়া হয়েছিল। এরপর খবর পাঠানো হয় চারজন নয়, আটজন প্রয়োজন। কথা ছিল ডাকাতির ২০ শতাংশ টাকা তাদের দেওয়া হবে। সানোয়ার লোক সংগ্রহে সুনামগঞ্জের বালু ব্যবসায়ী বদরুলের সঙ্গে। এরপর সানোয়ার বদরুল মিলে ডেকে আনা হয় সনাই, মিজান, হিমন, বাদশা, হৃদয়, মোস্তফা, মিলন ও জনিকে। তাদের রাখা হয় বনানীর একটি হোটেলে।

৮ মার্চ রাতে সানি প্ল্যান্টের চালক সোহেল রানা মাসুদ নামে পরিচয় দিয়ে কালো হাইস গাড়ীটি ভাড়া করা হয়। এজন্য সিম ও মোবাইল নেওয়া হয়। পরদিন ভোর সাড়ে ৫টায় সবাই বনানীর আবাসিক হোটেল থেকে বেরিয়ে হেঁটে কুর্মিটোলা যান। সেখানে মোট ১২ জন মিলে রেন্ট এ কারের চালক আকাশ মাতবরকে বেঁধে চলে যায় মিরপুর ডিওএইচএস এলাকায় যায়। সেখানে মানি প্ল্যান্টের টাকা ডাকাতি করে।

বাকি ৩ কোটি টাকা উদ্ধারে সাঁড়াশি অভিযানে ডিবি
ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বলেন, আমরা বিভিন্ন জেলায় অভিযান পরিচালনা করে ১৩ ডাকাতকে গ্রেপ্তার করেছি। তারা সব আদালতে স্বীকার করেছে। আমরা এ পর্যন্ত ডাকাতির আট কোটি ৩০ লাখ ৫ হাজার ৫০০ টাকা উদ্ধার করেছি।

হারুন বলেন, অধিকাংশ ডাকাতির ঘটনায় ২০ শতাংশ টাকা উদ্ধার করতে পারি। কারণ ডাকাতরা টাকা খরচ করে ফেলে। তবে এই ডাকাতির ঘটনায় আমরা ৮০ শতাংশ টাকা উদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছি। বাকি তিন কোটি টাকা উদ্ধারে আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।

অধরা তিন ডাকাত জনি, মোস্তফা হিমনের সন্ধান মেলেনি
তদন্তে উঠে এসেছে ওই ডাকাতির ঘটনায় জড়িত জনি মোস্তফা ও হিমন নামে আরও তিন ডাকাত পলাতক। তদন্ত সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা  বলেন, জনি ও মোস্তফার বাড়ি সুনামগঞ্জ তাহিরপুরে ও হিমনের বাড়ি সুনামগঞ্জ সদরে। ইতোমধ্যে মোস্তফা অবৈধভাবে স্থলপথে ভারতে পালিয়ে গেছেন বলে তথ্য পাওয়া গেছে। জনি ও হিমনকে ধরার চেষ্টা চলছে।

মিরপুর গোয়েন্দা পুলিশের উপ-কমিশনার (ডিসি) মানস কুমার পোদ্দার  বলেন, চাঞ্চল্যকর এই ডাকাতির ঘটনায় সব আসামি গ্রেপ্তার ও সব টাকাও উদ্ধার এখনো সম্ভব হয়নি। এখনো ৩/৪ জন পলাতক রয়েছে। তারা ভাড়াটে ডাকাত হিসেবে ডাকাতির কাজে অংশ নিয়েছিলেন। তাদের গ্রেপ্তারে সর্বাত্মক চেষ্টা চলছে। আমাদের একাধিক টিম কাজ করছে।

আরও খবর: