ক্যাম্পাস

ক্ষমতার ছড়ি ছাত্রলীগের হাতে

  জাগো কণ্ঠ ডেস্ক ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২২ , ১১:৩৮ পূর্বাহ্ণ

প্রায় ১৪ বছর একটানা ক্ষমতায় রয়েছে আওয়ামী লীগ। ফলে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে তৈরি হয়েছে আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের একক আধিপত্য। আর এতে করে ক্যাম্পাসে সহাবস্থান বলতে যা ছিল তা একেবারেই হারিয়ে যাচ্ছে। 

আওয়ামী লীগের প্রধান বিরোধী দল বিএনপির ছাত্র সংগঠন ছাত্রদলের উল্লেখযোগ্য কোনো তৎপরতা নেই কোথাও। কখনও কখনও তারা স্রেফ নিজেদের অস্তিত্বের জানান দেওয়ার চেষ্টা করলে রুখে দাঁড়ায় ছাত্রলীগ। মূলত বাম ছাত্র সংগঠনগুলোই এখনও ক্যাম্পাসে নিজেদের টিকিয়ে রাখতে পেরেছে, বিভিন্ন ইস্যুতে আন্দোলন-বিক্ষোভ-কর্মসূচি দিয়ে যাচ্ছে।

সার্বিক পরিস্থিতি দাঁড়িয়েছে- ছাত্রলীগের দাপটে রাজনৈতিক সহাবস্থান নিশ্চিত করা যাচ্ছে না বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। সর্বশেষ গত ২৭ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢোকার চেষ্টা করে হামলার শিকার হয়েছে ছাত্রদল।

এ বছর আরও দু’বার ক্যাম্পাসে ঢুকতে চেয়ে ছাত্রলীগের হামলার শিকার হয় ছাত্রদল। এর মধ্যে গত অক্টোবরে ১৮ মাস পর রাজনীতির আঁতুরঘর খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনে পা রাখে ছাত্রদল। মধুর ক্যান্টিন থেকে বের হয়ে সেদিন ক্যাম্পাসে মিছিলও করে ছাত্রদল। তবে সেদিনও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের সরব অবস্থান ছিল ক্যাম্পাসে ছাত্রদলের ফেরা ঘিরে।

গত মাসে ছাত্র অধিকার পরিষদের দুই নেতাকে মারধর করে পরে ক্ষমা চান ছাত্রলীগের কয়েকজন কর্মী।

দলীয় প্রতিপক্ষকে নানাভাবে দমন-পীড়ন ছাড়াও সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপরও নানা নির্যাতনের অভিযোগ রয়েছে ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে। নিয়মের ব্যত্যয় ঘটলে  গেস্টরুম নির্যাতনের শিকার হতে হয় শিক্ষার্থীদের। প্রকাশ্যে ভিন্ন মতের রাজনীতির সাথে যুক্ত থেকে হলে থাকতে পারার নজির এখন নেই বললেই চলে।

মঙ্গলবার বিকেলে ছাত্রদলের নেতা-কর্মীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকলে তাদের ওপর চড়াও হন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা

উদ্ভূত এ পরিস্থিতির জন্য প্রশাসনের শক্ত ভূমিকা না থাকাকেই দায়ী করছেন সংশ্লিষ্টরা।

হলগুলোতে প্রশাসনের ভূমিকায় ছাত্রলীগ 
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আবাসিক হলগুলো পরিচালনার জন্য হল প্রশাসন থাকলেও বাস্তবে হলের নিয়ন্ত্রণ তাদের কাছে থাকে না। প্রশাসনের পক্ষ থেকে শিক্ষার্থীদের হল নির্ধারণ করে দেওয়া হলেও নবীন শিক্ষার্থীদের হলে তোলা, ছাত্রদের বিভিন্ন হলের কোন কক্ষে কে থাকবেন, তা নিয়ন্ত্রণ করে মূলত ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন ছাত্রলীগ।

ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থেকে প্রোগ্রাম, গেস্টরুমে অংশ নিয়ে তবেই হলে থাকার সুযোগ হয়। ছাত্রলীগ আরোপিত নিয়মনীতি না মানলে গেস্টরুম নির্যাতনের শিকার হতে হয় শিক্ষার্থীদের। হলও ছাড়তে হয়েছে অনেক শিক্ষার্থীকে। চলতি বছর এমন অন্তত ৫টি ঘটনা ঘটেছে। সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে শিপন মিয়া নামে এক শিক্ষার্থী নির্যাতনের শিকার হয়ে তিনদিন বাইরে থেকে পরে মীমাংসার মাধ্যমে হলে ওঠেন। বঙ্গবন্ধু হলের আবু তালিব নামে এক শিক্ষার্থী ছয় মাসেরও বেশি সময় আছেন হলের বাইরে।

আগস্ট মাসেই ভিন্নমতের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত সন্দেহে মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হল ও জসিম উদ্দিন হলের দুই শিক্ষার্থীকে হল প্রশাসনের হাতে তুলে দেয় ছাত্রলীগ। তাদের মধ্যে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের মিফতাহুল মারুফ নামের একজনকে প্রায় ১৫ ঘণ্টা শাহবাগ থানায় আটকে রাখা হয়। এছাড়া জসিম উদ্দিন হলের এক শিক্ষার্থীকে হল থেকে বের করে দেওয়া হয়।

এছাড়া জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ব্যঙ্গাত্মক পোস্ট দেওয়ায় মুহসীন হল থেকে এক ছাত্রকে হলছাড়া করার অভিযোগ উঠেছে ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে। সম্প্রতি স্যার এ এফ রহমান হল ছাত্রলীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনে সিভি জমা না দেওয়ায় হল থেকে বের করে দেওয়া হয় আমান উল্লাহ নামে এক শিক্ষার্থীকে। হল ছাত্রলীগ সূত্রে জানা গেছে হল সভাপতি রিয়াজুল ইসলামের অনুসারী সামিউজ্জামান সামি বন্দুকের ভয় দেখিয়ে এই শিক্ষার্থীকে বের করে দেন।

নিজেরাও জড়ান বিরোধে 
এক নবীন শিক্ষার্থীকে হলে তোলা নিয়ে গত  ৮ সেপ্টেম্বর মুহসীন হল ছাত্রলীগের দুই গ্রুপে হাতাহাতির ঘটনা ঘটেছে। নবীন শিক্ষার্থী তোলার সময় ছেলেদের প্রায় প্রত্যেক হলে এমন ঘটনা ঘটে। প্রশাসনের পক্ষ থেকেও দৃশ্যমান কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায় না। এছাড়া কক্ষ নিয়ন্ত্রণ ও ভাগাভাগি নিয়ে হলগুলোতে প্রায়ই বিরোধে জড়িয়ে পড়ে ছাত্রলীগের বিভিন্ন পক্ষ। তবে হল প্রশাসন বলছে, হলে তোলা কিংবা আবাসিক কক্ষ বণ্টন করার দায়িত্ব প্রশাসনের। এ দায়িত্ব কোনো সংগঠনকে দেওয়া হয়নি।

হলে থাকতে হলে মানতে হয় ছাত্রলীগের নির্দেশনা 
হলে থাকতে শিক্ষার্থীদের জন্য এখন নির্দেশনাও জারি করছে ছাত্রলীগ। নির্দেশাগুলোর মধ্যে রয়েছে- হলের ভেতর এবং বাইরে ‘বড় ভাইদের’ সালাম দিতে হবে। সালাম দেওয়ার সময় ডান হাত দিয়ে হ্যান্ডশেক করতে হবে, বাম হাত পেছনে রাখতে হবে। এ সময় বড় ভাইদের হাতে ঝাঁকি বা চাপ দেওয়া যাবে না। ছাত্রলীগের সকল প্রোগ্রামে নিয়মিত অংশ নিতে হবে। হলে থেকে ছাত্রলীগ ব্যতীত অন্য কোনো রাজনৈতিক সংগঠন যেমন- ছাত্রদল, ছাত্রশিবির এবং বাম সংগঠন করা যাবে না। ছাত্রলীগ ছাড়া অন্য কোনো সংগঠন করলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। হলের যেকোনো ব্যাপারে ‘ইমিডিয়েট বড় ভাইদের’ সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলে গণ্য হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হলে থাকতে হলে মানতে হবে এই নিয়মগুলো। যদিও হলে ওঠার সময় হল কর্তৃপক্ষের দেওয়া নির্দেশনামায় এ ধরনের কোনো নিয়ম নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাদেশেও নেই এ ধরনের কোনো নির্দেশনা। হল ছাত্রলীগের নামে জারিকৃত একটি নির্দেশনামায় এসব দেখা যায়। হলের শিক্ষার্থীদের এ নির্দেশনাগুলোর বাইরে অন্য অনেকগুলো অদ্ভুত নিয়ম মেনে চলতে হয়। যেগুলো না মানলে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হতে হয় প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের।

ছাত্রলীগের হামলায় ছাত্রদলের অন্তত ১০ জন নেতাকর্মী আহত হন

পরিচয় গোপন রাখার শর্তে জিয়াউর রহমান হলের এক শিক্ষার্থী বলেন, গেস্টরুমে বড় ভাইয়েরা প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের বোকা বানানোর জন্য অদ্ভুত অদ্ভুত প্রশ্ন করে। অনেক সময় নানান অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি নিজেরাও করে, প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদেরও করতে বাধ্য করে। পান থেকে চুন খসলেই নানাভাবে অপমান-নির্যাতন করা হয়।

আরও খবর: