জাতীয়

সংকটকালে পুলিশ বাহিনীর দায়িত্ব নিয়ে যা বললেন নতুন আইজিপি

  জাগোকন্ঠ ৭ আগস্ট ২০২৪ , ৭:২১ অপরাহ্ণ

নিজস্ব প্রতিবেদক:
ছাত্র আন্দোলন থেকে উদ্ভূত নজিরবিহীন গণবিক্ষোভ, সহিংসতা, প্রাণহানির মধ্যে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ভেঙে পড়া পুলিশ বাহিনীর দায়িত্ব নিয়েছেন ময়নুল ইসলাম। গত দেড় দশকে সরকারের দমন-পীড়নের হাতিয়ার হিসেবে পুলিশ বাহিনীকে মারাত্মকভাবে ব্যবহার করা হয়েছে। কোটা সংস্কারের দাবিতে গড়ে ওঠা ছাত্র আন্দোলন দমনে পুলিশ যেভাবে নির্বিচার গুলিসহ মাত্রাতিরিক্ত বলপ্রয়োগ করেছে, তার মধ্যে নিবর্তনমূলক পুলিশ বাহিনীর চরম প্রতিফলন ঘটেছে।

গত সোমবার গণবিক্ষোভের মুখে শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নেওয়ার পর এর মধ্যেই নোবেলজয়ী ড. মোহাম্মদ ইউনূসকে প্রধান করে নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের সিদ্ধান্ত হয়েছে।

সেনাবাহিনী, প্রশাসন, বিচার বিভাগে রদবদল শুরু হয়েছে। সহিংসতার মধ্যে বাহিনী হিসেবে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে পুলিশ। চরম আক্রোশের শিকার হয়ে সহিংসতার মধ্যে প্রাণ হারিয়েছেন অনেক সদস্য। কয়েকশ থানাসহ পুলিশের বহু স্থাপনা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে।

পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) আবদুল্লাহ আল মাহমুদ চৌধুরীকে এরই মধ্যে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। এরই মধ্যে দায়িত্ব নিয়ে নতুন আইজিপি ময়নুল ইসলাম সংবাদ সম্মেলন করেছেন। তিনি আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সারা দেশে পুলিশের কার্যক্রম শুরুর নির্দেশ দিয়েছেন। এ ছাড়া সমাজের নিরাপত্তা নিশ্চিতে থানায় থানায় নাগরিক কমিটি গঠন করার ঘোষণা দিয়েছেন। সংবাদ সম্মেলনে তাঁর বক্তব্য পাঠকের জন্য হুবহু তুলে ধরা হল-

বাংলাদেশ পুলিশের আইজিপি হিসেবে আমাকে দায়িত্ব প্রদান করায় মহান আল্লাহপাকের কাছে শুকরিয়া আদায় এবং মহামান্য রাষ্ট্রপতির প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি। আজ এক বিশেষ পরিস্থিতিতে আমি আপনাদের সম্মুখে হাজির হয়েছি। বিরাজমান বিভিন্ন অনিয়ম, দুর্নীতি ও নিবর্তনমূলক কার্যক্রমের ফলে সদ্য সংঘটিত ছাত্র-জনতার বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের মাধ্যমে অভূতপূর্ব গণদাবি প্রতিষ্ঠা লাভ করে। আমরা এখন এক নতুন বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় নিয়ে যাত্রা শুরু করেছি। এই আন্দোলনে ছাত্র, সাধারণ মানুষ, পুলিশসহ অনেকে শহীদ হয়েছেন। আমি প্রত্যেক বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি। তাঁদের শোক সন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জ্ঞাপন করছি।

বাংলাদেশ পুলিশ দেশ ও জনগণের কল্যাণে নিয়োজিত একটি ঐতিহ্যবাহী পেশাদার ও সেবাধর্মী প্রতিষ্ঠান। দেশের প্রয়োজনে যেকোনো সংকটময় মুহূর্তে এই বাহিনী সব সময় সর্বোচ্চ আন্তরিকতা, নিষ্ঠা ও পেশাদারিত্বের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছে। বর্তমান বৈষম্যবিরোধী যৌক্তিক আন্দোলনে আমাদের পূর্বের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাগণ দেশবাসীর প্রত্যাশা অনুযায়ী দায়িত্ব পালন করতে পারেননি। এজন্য বাংলাদেশ পুলিশের পক্ষ হতে আমি পুলিশ প্রধান হিসেবে আন্তরিকভাবে দুঃখিত। আমরা এখন হতে আমাদের ওপর অর্পিত আইনি সকল দায়িত্ব পালনে দৃঢ়ভাবে অঙ্গীকারবদ্ধ।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সাম্প্রতিক সময়ে ছাত্র, সাধারণ মানুষ, পুলিশসহ প্রতিটি হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত করতে আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। দেশের শান্তি-শৃঙ্খলা ও স্থিতি ফিরিয়ে আনতে আমরা সর্বাত্মকভাবে সচেষ্ট রয়েছি। বাংলাদেশ পুলিশ সর্বদা জনগণের জান-মালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে নিরলসভাবে কাজ করছে। আমরা বিশ্বাস করি, জনগণই রাষ্ট্রের মূল শক্তি। তাই, আমরা সবসময় জনগণের পাশে থেকে জনগণকে সর্বোচ্চ সেবা প্রদানে বদ্ধ পরিকর। আপনাদের সুচিন্তিত মতামতকে অগ্রাধিকার দিয়ে একটি দক্ষ, জনবান্ধব, প্রযুক্তি নির্ভর আধুনিক ও জবাবদিহিমূলক পেশাদার পুলিশ সংস্কারের ব্যবস্থা গ্রহণ করব। পারস্পরিক সৌহার্দ্য, সম্প্রীতি, ভ্রাতৃত্ববোধে উজ্জীবিত হয়ে সমন্বয়ের মাধ্যমে আমরা সকলে একযোগে কাজ করে উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাবো, ইনশাআল্লাহ।

আমাদের কতিপয় উচ্চাভিলাষী, অপেশাদার কর্মকর্তার কারণে এবং কর্মকৌশল প্রণয়নে বলপ্রয়োগের স্বীকৃত নীতিমালা অনুসরণ না করা এবং মানবাধিকার লঙ্ঘন করা ও নেতৃত্বের ব্যর্থতায় আমাদের অনেক সহকর্মী আহত, নিহত এবং নিগৃহীত হয়েছেন। এই সন্ধিক্ষণে আমি সকল পুলিশ সদস্যকে আন্তরিকভাবে আহ্বান জানাই, আপনারা দেশ ও জাতির প্রয়োজনে শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য হিসেবে নিজ নিজ দায়িত্ব পালনে আত্মনিয়োগ করুন। আপনাদের জীবনমানের উন্নয়ন এবং সার্বিক কল্যাণ নিশ্চিতকরণে আমরা সকল ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

দেশের এই নতুন অধ্যায়ের সূচনা লগ্নে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ, দেশপ্রেমিক সশস্ত্র বাহিনী, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, গণমাধ্যম, সুশীল সমাজ এবং দেশের সম্মানিত সকল নাগরিককে তাঁদের আন্তরিক ভূমিকার জন্য বিশেষভাবে ধন্যবাদ জানাই। আমি বাংলাদেশ পুলিশের আইজিপি হিসেবে আমাদের পেশাগত দায়িত্ব পালনে সকলের আন্তরিক সহযোগিতা কামনা করছি। সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আমরা একটি সুখী, সমৃদ্ধ, শান্তিপূর্ণ ও নিরাপদ বাংলাদেশ গড়ে তুলব, ইনশা আল্লাহ।

আমি আপনাদের মাধ্যমে সকল স্তরের পুলিশ সদস্যদের প্রতি কিছু নির্দেশনা প্রদান করছি। এই নির্দেশনা আপনাদের মাধ্যমে ব্যাপক প্রচারের অনুরোধ জানাচ্ছি।

– রাজারবাগ পুলিশ লাইনস, পিওএম, এপিবিএনস, সকল মেট্রোপলিটন এবং জেলা পুলিশ লাইনসহ বিশেষায়িত সকল পুলিশ ইউনিটের সব অফিসার এবং ফোর্সকে আগামী ৮ আগস্ট ২০২৪ তারিখ বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার মধ্যে কর্মস্থলে যোগদানের জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

– মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার ও জেলার পুলিশ সুপারগণ স্ব-স্ব অধিক্ষেত্রের থানা এলাকায় জ্যেষ্ঠ নাগরিক, পেশাজীবী, ছাত্র প্রতিনিধি, রাজনৈতিক ও গণমাধ্যম ব্যক্তিবর্গের সমন্বয়ে নাগরিক নিরাপত্তা কমিটি গঠন করবেন। আমরা জনসাধারণের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি বর্ণিত কমিটি থানা ও থানা এলাকার নিরাপত্তা বিধানে আপদকালীন সহায়ক ভূমিকা রাখবে এবং পরবর্তীতে এর চূড়ান্ত রূপরেখা প্রণয়ন করা হবে।

– আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সকল মেট্রোপলিটন, জেলা, নৌ, রেলওয়ে ও হাইওয়ে থানার অফিসার ও ফোর্স স্ব-স্ব পুলিশ লাইনসে যোগাদানের জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

– আমি পুলিশ বাহিনীর শৃঙ্খলা বজায় রাখার স্বার্থে সকল স্তরের সহকর্মীকে সামাজিক মাধ্যমে কোন প্রকার ব্যক্তিগত, সমিতি, ব্যাচ, অ্যাসোসিয়েশনের মাধ্যমে কোন দাবি, মন্তব্য, প্রতিউত্তর প্রদানে বিরত থাকার নির্দেশ প্রদান করছি।

বাংলাদেশ পুলিশের সকল উদ্যোগ ও কার্যক্রমে আমরা সবসময় আপনাদের সার্বিক সহযোগিতা পেয়ে আসছি। আগামীতেও এই ধারা অব্যাহত থাকবে বলে আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি। আজকের এই প্রেস ব্রিফিং-এ আপনাদের মূল্যবান সময় প্রদানের জন্য সকলকে আন্তরিক ধন্যবাদ।

আমি আর একটি কথা পুনর্ব্যক্ত করতে চাই, আমরা বর্তমান পরিস্থিতি যথাযথ মূল্যায়ন করে জননিরাপত্তাকে প্রাধান্য দিয়ে জনশৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা গ্রহণ করেছি এবং সে লক্ষ্য পূরণে সকলে মিলে কাজ করছি। আমি আজকে কোনো প্রশ্ন ও মন্তব্য না নিয়ে সকলকে আবারও ধন্যবাদ জানিয়ে এ প্রেস ব্রিফিং শেষ করছি।

আমি সকলের সার্বিক মঙ্গল কামনা করছি।
খোদা হাফেজ। আল্লাহ আমাদের সহায় হোন।’