রাজনীতি

এমপি গোলাপের ৯ বাড়ির খোঁজে যুক্তরাষ্ট্রে এমএলএআর

  জাগো কণ্ঠ ডেস্ক ২৬ জুন ২০২৩ , ৩:১৩ পূর্বাহ্ণ

মাদারীপুর- ৩ আসনের আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য (এমপি) মোহাম্মদ আবদুস সোবহান মিয়ার (গোলাপ) যুক্তরাষ্ট্রে নয়টি বাড়ি ক্রয়সহ অর্থপাচারের অভিযোগ অনুসন্ধান শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। সংস্থাটির গঠিত বিশেষ টিম এরই মধ্যে নথিপত্র তলবসহ বিভিন্ন কাজ শুরু করে দিয়েছে।

দুদকের কাছে সুনির্দিষ্ট তথ্য-উপাত্ত থাকায় যুক্তরাষ্ট্রে আসলেই গোলাপের নামে বাড়ি রয়েছে কি না, তা যাচাই-বাছাইয়ে দেশটিতে গত ২০ জুন এমএলএআর (মিউচ্যুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট রিকোয়েস্ট) পাঠানো হয়েছে বলে জানা গেছে। দুদকের ঊর্ধ্বতন একটি সূত্র  বিষয়টি নিশ্চিত করেছে।

দুদকের কাছে সুনির্দিষ্ট তথ্য-উপাত্ত থাকায় যুক্তরাষ্ট্রে এমপি গোলাপের নামে বাড়ি আছে কি না, তা যাচাইয়ে দেশটিতে গত ২০ জুন এমএলএআর পাঠানো হয়েছে / ফাইল ছবি 

এমএলএআর পাঠানোর পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের কোনো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আবদুস সোবহান গোলাপ কিংবা তার পরিবারের কোনো সদস্যের আর্থিক লেনদেনের তথ্য রয়েছে কি না, এ সংক্রান্ত তথ্য-উপাত্ত চেয়ে বাংলাদেশ ব্যাংককে চিঠিও দেওয়া হয়েছে।

অভিযোগে আওয়ামী লীগের এ সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে নিউইয়র্কে মোট নয়টি প্রপার্টি বা সম্পত্তির (ফ্ল্যাট বা বাড়ি) মালিক হওয়ার কথা বলা হয়েছে। এসব সম্পত্তির মূল্য ৪০ লাখ ডলারের বেশি। বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৪৩ কোটি টাকা (এক ডলার সমান ১০৮ টাকা ধরে)।

এ বিষয়ে দুদকের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা  বলেন, যেহেতু মূল অভিযোগই হলো টাকা পাচার ও যুক্তরাষ্ট্রে বাড়ি ক্রয়। তাই ওই অভিযোগ যাচাই-বাছাইয়ে অবশ্যই বিদেশের তথ্য-উপাত্ত লাগবে। এছাড়া নিউইয়র্কে তার বাড়ির ঠিকানাসহ অভিযোগ দুদকের কাছে রয়েছে। স্বাভাবিকভাবে ওই ঠিকানা ও প্রকৃত মালিকের তথ্য লাগবে। বিদেশের যে কোনো তথ্য সংগ্রহের আইনি মাধ্যম হচ্ছে এমএলএআর। তাই কমিশনের অনুমোদনক্রমে তা পাঠানো হয়েছে।

তিনি বলেন, আদালতের নির্দেশনা অনুসরণ করে আমরা অনুসন্ধান শুরু করেছি। সময়ের সীমাবদ্ধতা রয়েছে। এমন অনুসন্ধান দ্রুত শেষ করার চেষ্টা করছে দুদকে।

এমএলএআর কী

এমএলএআরের পূর্ণাঙ্গ রূপ হচ্ছে মিউচ্যুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট রিকোয়েস্ট। অভিযোগ সংশ্লিষ্ট তথ্য-উপাত্ত পাওয়ার এক ধরনের চিঠি বা আবেদন। একটি দেশের দায়িত্বশীল সংস্থা সুনির্দিষ্ট তথ্যের বিষয়ে জানতে অন্য দেশের দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থার কাছে আইনি প্রক্রিয়ায় এ ধরনের এমএলএআর প্রেরণ করে থাকে। জাতিসংঘের দুর্নীতিবিরোধী কনভেনশনে (আনকাক) সই করা দেশগুলোর মধ্যে তথ্য আদান-প্রদানে এমএলএআর বেশি ব্যবহৃত হয়। এর আগে বাংলাদেশ থেকে আগে অ্যাটর্নি জেনারেলের মাধ্যমে এমএলএআর প্রেরণ করা হতো। বর্তমানে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে এমএলএআর প্রেরণ করা হয়।

দুদকে দাখিল হওয়া অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, আবদুস সোবহান গোলাপ যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক এবং অন্য দেশে একাধিক বাড়ি কিনেছেন। তিনি ২০১৮ সালের নির্বাচনী হলফনামায় এ তথ্য গোপন করেন। ক্ষমতার অপব্যবহার ও দুর্নীতির মাধ্যমে দেশে-বিদেশে বিপুল পরিমাণ অবৈধ সম্পদ অর্জন করেন আওয়ামী লীগের এ সংসদ সদস্য।

মাদারীপুর- ৩ আসনের সংসদ সদস্য মোহাম্মদ আবদুস সোবহান মিয়া (গোলাপ) / ফাইল ছবি

তথ্য অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের বৈশ্বিক নেটওয়ার্ক ‘অর্গানাইজড ক্রাইম অ্যান্ড করাপশন রিপোর্টিং প্রজেক্ট’ বা ওসিসিআরপি তাদের ওয়েবসাইটে করা একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেখানে উল্লেখ করা হয়, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য মো. আবদুস সোবহান মিয়া (গোলাপ) যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে ৪০ লাখ ডলার ব্যয়ে একাধিক বাড়ি কিনেছেন।

ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মো. আবদুস সোবহান মিয়া ২০১৪ সালে প্রথম নিউইয়র্কে অ্যাপার্টমেন্ট কেনা শুরু করেন। ওই বছর নিউইয়র্কের জ্যাকসন হাইটস এলাকায় একটি সুউচ্চ ভবনে অ্যাপার্টমেন্ট কেনেন তিনি। পরের পাঁচ বছরে তিনি নিউইয়র্কে একে একে মোট নয়টি প্রপার্টি বা সম্পত্তির (ফ্ল্যাট বা বাড়ি) মালিক হন। এসব সম্পত্তির মূল্য ৪০ লাখ ডলারের বেশি।

২০১৪ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে মোহাম্মদ আবদুস সোবহান মিয়া জ্যাকসন হাইটসের একটি আলিশান ভবনে পাঁচটি কনডোমিনিয়াম কেনেন। ওই সময় যার দাম ছিল প্রায় ২ দশমিক ৪ মিলিয়ন ডলার (প্রায় ২৫ কোটি টাকা)। এর কাছাকাছি কয়েকটি ভবনে তিনি আরও তিনটি অ্যাপার্টমেন্ট কেনেন। যার দাম ছয় লাখ ৮০ হাজার ডলার (প্রায় সাত কোটি টাকা)।

সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে জ্যাকসন হাইটসে আরও একটি সম্পত্তি কেনেন তিনি। যার মূল্য প্রায় এক দশমিক দুই মিলিয়ন ডলার (প্রায় সাড়ে ১২ কোটি টাকা)। এসব সম্পত্তির সবই নগদ টাকায় কেনা হয়।

গত ১৩ জানুয়ারি প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, আশির দশকে বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার পর মোহাম্মদ আবদুস সোবহান মিয়া কম বেতনের কাজ, যেমন- পিৎজা তৈরি, ওষুধের দোকানে কাজ, লাইসেন্স ছাড়া ট্যাক্সি চালাতেন বলে জানান তার সহকর্মীরা। এসব কাজ থেকে যে আয় হয় তা দিয়ে এভাবে অ্যাপার্টমেন্ট বা বাড়ি কেনা সম্ভব নয়। এসব সম্পত্তি কিনতে বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাঠানো হয়েছে কি না— তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। কারণ, বাংলাদেশ থেকে সম্পত্তি কেনার জন্য বিদেশে অর্থ পাঠানোর সুযোগ নেই।

যার বিরুদ্ধে এত অভিযোগ সেই আবদুস সোবহান মিয়ার (গোলাপ) সঙ্গে মোবাইলের যোগাযোগ করা হলেও কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

গত ২৭ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্টের বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি খিজির হায়াতের হাইকোর্ট বেঞ্চ আবদুস সোবহান মিয়ার (গোলাপ) যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে নয়টি বাড়ি কেনার বিষয়ে অনুসন্ধান করতে দুদককে নির্দেশ দেন।

গত ২৬ জানুয়ারি আবদুস সোবহান মিয়ার (গোলাপ) বিরুদ্ধে দুদকে অভিযোগপত্র জমা দেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন। এ বিষয়ে দুদকের আইনজীবী খুরশিদ আলম খান  বলেন, হাইকোর্টের আদেশের পর নির্দেশনা দুদকের পাঠানো হয়েছে। এর পরের অগ্রগতি আমার জানা নেই।

আবদুস সোবহান মিয়া ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে মাদারীপুর- ৩ আসন থেকে জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন। গত ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের জাতীয় সম্মেলনে দলের কেন্দ্রীয় কমিটিতে তিনি প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদকের পদ পান। দলের কেন্দ্রীয় দপ্তর সম্পাদকও ছিলেন তিনি।

আবদুস সোবহান মিয়া গোলাপের বিরুদ্ধে দুদকে অভিযোগপত্র জমা দেওয়ার পর ব্যারিস্টার সুমন গণমাধ্যমকে বলেন, তিনি (আবদুস সোবহান মিয়া) যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কসহ অন্যান্য স্থানে একাধিক বাড়ি কেনার তথ্য ২০১৮ সালের নির্বাচনী হলফনামায় গোপন করেন। এজন্য তদন্ত করে প্রয়োজনীয় আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য অনুরোধ করছি। তিনি ক্ষমতার অপব্যবহার ও দুর্নীতির মাধ্যমে দেশে-বিদেশে বিপুল অবৈধ সম্পদ অর্জন করেছেন। আব্দুস সোবহান গোলাপ ২০১৪-১৫ সালে যখন এমপি ছিলেন তখন তিনি কী পরিমাণ দেশসেবা করেছেন যে সেবা করতে করতে নিউইয়র্কে নয়টা প্রপার্টিজ করেছেন। যেগুলো তার নিজের নামে আছে এবং এখন পর্যন্ত তিনি বিষয়টি অস্বীকার করেননি।

‘শপথ নেওয়ার সাত মাস পর তিনি আমেরিকান সিটিজেনশিপ ত্যাগ করেন। অথচ আমাদের কনস্টিটিউশনে (সংবিধানে) আছে, আপনার যদি বিদেশি নাগরিকত্ব থাকে তাহলে কোনোভাবেই সংসদ সদস্য হিসেবে শপথ নিতে পারবেন না। এ বিষয় নির্বাচন কমিশনকে প্রশ্ন করা হয়েছিল। নির্বাচন কমিশন স্পষ্ট বলেছে, বিষয়টি দুদক দেখবে।’

আরও খবর: