দেশজুড়ে

বাবা-ছেলের মানবপাচার ব্যবসায় নিঃস্ব ৪ পরিবার

  জাগো কণ্ঠ ডেস্ক ১৫ জুন ২০২৩ , ৮:৪৭ পূর্বাহ্ণ

বাবা-ছেলের যোগসাজশে চলে মানবপাচার ব্যবসা। বাবা থাকেন গ্রামে, কাজ করেন এজেন্ট হিসেবে। অন্যদিকে ছেলে থাকেন দেশের বাইরে, লিবিয়ার এজেন্ট হিসেবে নিয়োজিত। তাদের টার্গেট গ্রামের সহজ-সরল ও অশিক্ষিত মানুষ।

এ চক্রের ফাঁদে পড়ে নিঃস্ব হয়েছে যশোরের চুড়ামনকাঠি ইউনিয়ন ও পাবনা সদরের চাঁদের বাজার এলাকার চার যুবক। ভালো কাজের আশায় লাখ লাখ টাকা দিয়ে লিবিয়ায় গিয়ে অত্যাচার-নির্যাতনের শিকার হয়ে পালিয়ে বাড়ি ফিরতে হয়েছে তাদের। তবে তাতেও মেলেনি রক্ষা, প্রাণে বাঁচতে ধার-দেনা, ঋণ ও  সুদে টাকা নিয়ে মুক্তিপণ হিসেবে এ চক্রকে দিতে হয়েছে। টাকা ফেরত চাইতে গেলে দেওয়া হচ্ছে হত্যার হুমকি, মিথ্যা মামলার ভয়ভীতি।

অভিযুক্ত এ চক্রের মূলহোতা লিবিয়া প্রবাসী বিপ্লব হোসেন যশোর সদর উপজেলার চুড়ামনকাঠি ইউনিয়নের আব্দুলপুর গ্রামের ইব্রাহিমের ছেলে। বিপ্লবের বাবা ইব্রাহিম ও বিপ্লবের ভাই ইকবালও দেশে থেকে মানবপাচার কাজে এজেন্ট হিসেবে কাজ করেন।

পাচার ও প্রতারণার শিকার ভুক্তভোগীরা হলেন- একই গ্রামের শওকত আলীর ছেলে সুমন হোসেন (২৩), পাশের হুজরপাড়া গ্রামের লাল মিয়ার ছেলে তরিকুল (২৫) এবং পাবনা জেলা সদরের চাঁদের বাজার গ্রামের আহমদের ছেলে নাজিম (২৪) ও কুরমান আলীর ছেলে মেহেদী (২৪)। বিপ্লবের এ চক্রের পাবনা এজেন্ট হিসেবে কাজ করছেন একই গ্রামের মৃত আইতজালের ছেলে লিবিয়া প্রবাসী মেসেজ।

সরেজমিনে অনুসন্ধানে জানা গেছে, ভালো কাজের প্রলোভন দিয়ে সুমন হোসেনকে সাড়ে চার লাখ টাকা চুক্তিতে গত বছরের ১৭ ডিসেম্বর লিবিয়ায় নিয়ে যান বিপ্লব হোসেন। এ কাজে উৎসাহিত ও সহযোগিতা করে বিপ্লবের বাবা ইব্রাহিম ও তার ভাই ইকবাল। সুমন লিবিয়ায় যাওয়ার পর তাকে বিভিন্ন সময়ে মিশর, দুবাই আবার পুনরায় লিবিয়ায় বিক্রি করে বিপ্লব। এরপর সুমনকে একটি ঘরে আটকে রেখে নির্যাতন চালিয়ে কয়েক দফায় ১৫ লাখ টাকা মুক্তিপণ হিসেবে হাতিয়ে নেন তারা।

ভুক্তোভোগী সুমন হোসেন বলেন, একই গ্রামের লোক হওয়ায় ইব্রাহিমের প্ররোচনায় ভালো কাজের আশায় আমি বিদেশে পাড়ি জমাই। কিন্তু আমি সেখানে যাওয়ার পর তারা আমাকে কয়েক দফা বিক্রি করে। সর্বশেষ আমাকে আটকে রেখে চাইনিজ কুড়ায় দিয়ে মারপিট করে খুন করার ভয় দেখিয়ে আমার বাড়ি থেকে ১৫ লাখ টাকা মুক্তিপণ হিসেবে হাতিয়ে নেয়। আমার আব্বা সুদে, জমি বন্ধক দিয়ে, আত্মীয় স্বজনের কাছ থেকে টাকা নিয়ে তাদের কাছে দেয়। তবুও তারা আমাকে ছাড়ে না। পরে আমি লিবিয়া থেকে পালিয়ে অ্যাম্বাসিতে এসে বাংলাদেশে ফিরে আসি।

ভুক্তভোগী সুমনের সহযাত্রী, একই গ্রামের তরিকুল বলেন, আমিও বিপ্লবের প্ররোচনায় সাড়ে চার লাখ টাকা চুক্তিতে বিদেশ গিয়েছিলাম। আমাকেও নির্যাতন করে মুক্তিপণ নিয়েছে। সুমনের আরও দুই সহযাত্রী পাবনার নাজিম ও মেহেদী জানায়, তাদের উভয়ের বাবা কাঁচামাল ব্যবসায়ী। একই গ্রামের এ মানব পাচারের কাজে জড়িত বিপ্লব চক্রের এজেন্ট লিবিয়া প্রবাসী মেসেজের প্ররোচণায় সাড়ে চার লাখ টাকা চুক্তিতে লিবিয়ায় যাই। কিন্তু সেখানে আমাদের উপর নির্যাতন চালিয়ে মুক্তিপণ আদায় করা হতো। একপর্যায়ে আমরা পালিয়ে চলে এসেছি। আমরা মুক্তিপণ দিতে দিতে নিঃস্ব হয়ে গেছি।

অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, বিপ্লবের এই চক্রের এজেন্ট শুধু পাবনা বা যশোরেই সীমাবদ্ধ নয়। এর এজেন্ট রয়েছে মাদারীপুর, ফরিদপুরসহ অন্যান্য জেলায়। বিপ্লব চক্র এই চার যুবকের পরিবার থেকে বিদেশ পাঠানো ও মুক্তিপণ বাবদ বিভিন্ন ব্যাংক, বিকাশ ও নগদে মোট ৬৫ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।

ভুক্তভোগী সুমনের বাবা শওকত আলী বলেন, আমি কৃষি কাজ করি। ছেলে বেশি শিক্ষিত না। এ কারণে ইব্রাহিমের কথা শুনে ছেলেকে বিদেশ পাঠাতে রাজি হই। কিন্তু আজ ইব্রাহিম এবং তার ছেলে বিপ্লবের ফাঁদে পা দিয়ে আমরা নিঃস্ব হয়ে গেছি। এখন আমরা টাকা চাইলে আমাদের খুন জখম এবং মামলা দিয়ে জেলে দেওয়ার ভয় দেখায়। বিপ্লব মুঠোফোনে মুক্তিপণ চাওয়ার সময় আমার কাছে স্বীকার করেছে, এটি নাকি তার ব্যবসা। সে এভাবে জন প্রতি মানুষ পাচারে ৫০ হাজার থেকে ২ লাখ টাকা আয় করে।

এ সব অভিযোগের ব্যাপারে ইকবাল হোসেন বলেন, আমার ভাই বিপ্লব বিদেশে থাকে। গ্রামের উন্নয়নের কথা চিন্তা করে গ্রাম থেকে সুমন ও তরিকুলকে বিদেশে নিয়েছিল। সুমন ও তরিকুল বিদেশে গিয়ে মাফিয়ার হাতে পড়ে। সেখান থেকে ছাড়াতে প্রয়োজনীয় টাকা আমাদের মাধ্যমে সুমনের কাছে পাঠিয়েছে তার পরিবার। এতে আমাদের কোনো দোষ নেই। আমরা ভালো করতে গিয়ে বিপদে পড়েছি। সবশেষে ইকবার তার বাবা ইব্রাহিম এবং ভাই বিপ্লবের বিরুদ্ধে সকল অভিযোগ অস্বীকার করেন।

চুড়ামনকাঠি ইউনিয়নের সাত নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য আনিছুর রহমান বলেন, গ্রামে একটা লোকও ইব্রাহিম এবং তার দুই ছেলে ইকবাল ও বিপ্লবকে কেউ ভালো বলে না। নিজ গ্রামের যুবকদের ব্যবহার করে এ আদম ব্যবসা শুরু করেছে তারা। প্রতারণা করে টাকা আত্মসাৎ করে অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়েছে। তাদের প্রতিবাদ করতে গেলে এলাকার মানুষদের তারা টাকা জোরে মামলা আর হত্যার ভয়ভীতি দেখায়।

আরও খবর: