দেশজুড়ে

নির্বিচারে কেয়াবন ধ্বংসের কারণে মোখার ভয়াবহতা দেখলো সেন্ট মার্টিন

  জাগো কণ্ঠ ডেস্ক ১৭ মে ২০২৩ , ১১:৫৬ পূর্বাহ্ণ

সেন্ট মার্টিন দ্বীপের কোনারপাড়ার বাসিন্দা আদনান। জন্ম থেকে শুরু করে তার শৈশব-কৈশোর কেটেছে এ দ্বীপে। তার ৩৫ বছর বয়সের জীবনে দ্বীপে ঘূর্ণিঝড় ‘মোখা’র মতো তাণ্ডব আর কখনো দেখেননি। বাপ-দাদার কাছে শুনেছেন ১৯৯১ সালের প্রলয়ংকারী ঘূর্ণিঝড়ের সময়ও সেন্টমার্টিনের এত ক্ষতি হয়নি। তবে এবার কেন এতো ভয়াবহতা? 

আদনানের ধারণা দ্বীপের কেয়াবন নির্বিচারে ধ্বংস হওয়ায় মোখার আঘাত এত ভয়াবহ হয়েছে। একসময় দ্বীপের চারপাশে কেয়াবনের যে ঝোপ ছিল তা এখন আর অবশিষ্ট নেই বলেই দ্বীপের এত ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।

মঙ্গলবার (১৬ মে) সকালে দ্বীপের বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা হয় জাগো কণ্ঠের। এ সময় আদনান বলেন, ঘূর্ণিঝড় মোখার তাণ্ডবে আমাদের দ্বীপে দুই হাজারের বেশি ঘরবাড়ি, দোকানপাট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে সম্পূর্ণ ভেঙে গেছে ১ হাজার ২০০টির বেশি ঘর। এর মধ্যে মাঝেরপাড়া, কোনারপাড়া, গলাচিপা, দক্ষিণপাড়া, পশ্চিমপাড়া, উত্তরপাড়ার অধিকাংশ কাঁচা ঘরবাড়ি মিশে গেছে মাটির সঙ্গে।

dhakapost

আদনান আরও বলেন, আমাদের দ্বীপকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষা করে প্রবাল ও কেয়াবন। আমাদের দ্বীপে কেয়াবন ও প্রবালকে বলা হয় দ্বীপের ‘রক্ষা দেয়াল’। যতবড় দুর্যোগ আসুক না কেন কেয়াবন ও প্রবাল আমাদের রক্ষা দেয়াল হিসেবে কাজ করে। কিন্তু দ্বীপের সারিবদ্ধ কেয়াবন উজাড় এবং প্রবাল ধ্বংস করা হচ্ছে প্রতিনিয়ত। পাঁচ বছর আগেও দ্বীপের চারপাশে কেয়াবন ছিল প্রায় ২০ কিলোমিটার। উজাড় হতে হতে সেই বন এখন ঠেকেছে ৮ কিলোমিটারে। প্রায় ১২ কিলোমিটার কেয়াবন নেই।

কেন এই কেয়াবন ও প্রবাল ধ্বংস করা হচ্ছে এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, দ্বীপের কেয়াবন উজাড়ের একমাত্র কারণ হোটেল, রিসোর্ট, রেস্তোরাঁসহ নানা স্থাপনা নির্মাণ। এসব স্থাপনা নির্মাণ করতে গিয়ে কেয়াবন আগুনে পুড়িয়ে ও কেটে ধ্বংস করা হয়েছে। এর ফলে সৈকতের বালিয়াড়ি বিলীন হচ্ছে। এর প্রভাবও ইতোমধ্যে পড়তে শুরু করেছে। দুই বছর ধরে সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাসে বিলীন হচ্ছে দ্বীপের শত শত নারকেলগাছ ও বসতবাড়ি, যা আগে কখনো হয়নি।

এ অভিযোগ শুধু একা আদনানের নয়। একই অভিযোগ জানিয়েছে দ্বীপের অন্য বাসিন্দারাও।

.dhakapost

জামাল হোসন নামে আরেক বাসিন্দা বলেন, এই ছোট্ট দ্বীপে ৪শ থেকে সাড়ে ৪শ হোটেল ও রিসোর্ট গড়ে উঠেছে। এসব হোটেলে মালিকদের সন্ধান করলে দেখবেন সব বহিরাগতরা। স্থানীয়রা একটি বালির বস্তা নিলেও তাদের আইনের আওতায় আনা হয়। আর বড় বড় হোটেল রিসোর্টের মালিকরা সাগর থেকে প্রবাল ও কেয়াবন উজাড় করে দিল তবুও প্রশাসন নিরব বসে আছে। এদের কারণে এই প্রাকৃতিক দুর্যোগ (ঘূর্ণিঝড় মোখা) আঘাত হেনেছে।

সরেজমিনে দিয়েও স্থানীয়দের এই অভিযোগের সত্যতা মেলে। কোনারপাড়া সৈকতে বেশ কয়েকটি হোটেলের পাশে কেয়াবন ও প্রবাল ধ্বংসের চিত্র ধরা পড়ে।

জানা যায়, আগুন ধরিয়ে দিয়ে উজাড় করা হয়েছে কেয়াবন। আর সাগর থেকে প্রবাল তুলে হোটেল রিসোর্টের সীমানা রক্ষা করা হচ্ছে। দ্বীপের বাসিন্দারা বলছেন অবশিষ্টটুকুও কত দিন টিকে থাকবে, তা নিয়ে সংশয়ে আছেন তারা। এভাবে চলতে থাকলে একদিন এই দ্বীপ পানির নিচে তলিয়ে যাবে।

সেন্টমার্টিনের আরেক বাসিন্দা জসিম উদ্দিন শুভ জাগো কণ্ঠকে বলেন, ঘূর্ণিঝড়ের দিন (১৪মে) সবাই আশ্রয় কেন্দ্র ছেড়ে ঘরে চলে যায়। বয়স্ক লোকরা বলাবলি করছিল এখানে কিসের ঘূর্ণিঝড়। কিছু হবে না। তারপরও আমরা বিজিবি, কোস্ট গার্ডদের সহায়তায় তাদের আশ্রয়কেন্দ্রে ফেরানোর চেষ্টা করি। ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে যায়। মোখা তাণ্ডব শুরু হয়ে গিয়েছিল। শুরু দিকে বাতাসের গতির সঙ্গে বৃষ্টি ছিল। মনে হচ্ছিল বাতাসের সঙ্গে সাগরের পানি কূলের দিকে চলে আসছে। ঘরবাড়ি, গাছপালা সবকিছু উড়িয়ে নিয়ে গেছে। যারা আশ্রয়কেন্দ্র ছেড়েছে তারা অনেকেই গাছ চাপা পড়ে আহত হয়েছেন। আমার শৈশব থেকেই এই পর্যন্ত এইরকম ঘূর্ণিঝড় দেখিনি। চিন্তা করছি দ্বীপ ছেড়ে চলে যাব। যেকোন সময় পানির নিচে তলিয়ে যেতে পারে এই দ্বীপ। কারণ দ্বীপ দিনদিন ছোট হয়ে যাচ্ছে। দ্বীপ ছোট হাওয়ার কারণ আগে দ্বীপের চারপাশে কেয়াবন ও প্রবাল ছিল। কিছু অসাধু লোক দ্বীপটাকে ধ্বংস করে ফেলছে। তাই দিন দিন দ্বীপ ভাঙন শুরু হয়েছে।

dhakapost

এভাবে কেয়াবন ধ্বংসের পেছনে স্থানীয় প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদপ্তরের গাফিলতিকে দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞ ও পরিবেশবাদীরা। আর স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, সেন্ট মার্টিনের পরিবেশ রক্ষাকারী কেয়াবন উজাড়ের প্রতিবাদ করেও সুফল পাচ্ছেন না তারা। কেননা ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের প্রভাবশালীরা ঠিকই পরিবেশ অধিদপ্তরসহ স্থানীয় প্রশাসনকে ‘ম্যানেজ’ করে অবকাঠামো নির্মাণ অব্যাহত রেখেছেন।

পরিবেশ সাংবাদিক ফোরাম কক্সবাজারের সাধারণ সম্পাদক এইচ এম নজরুল ইসলাম জাগো কণ্ঠকে বলেন, সেন্ট মার্টিন দ্বীপের ‘রক্ষাদেয়াল’ কেয়াবন উজাড় হচ্ছে প্রতিনিয়ত। সেন্ট মার্টিনে কেয়াবন ধ্বংসের পেছনে স্থানীয় প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদপ্তরের গাফিলতি দায়ী। কেয়াবনের কারণে ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে বালু স্থির থাকে, সরে যায় না। এই বন ধ্বংস হয়ে যাওয়ায় সেন্টমার্টিনের পরিবেশের ওপর বিপর্যয় নেমে আসবে। এখন ২০ কিলোমিটারের বন ঠেকেছে ৮ কিলোমিটারে। নানা স্থাপনা নির্মাণ করতে ধ্বংস করা হচ্ছে এসব কেয়াবন। এভাবে দ্বীপের ‘রক্ষা দেয়াল’ কেয়াবন উজাড় হলে ভবিষ্যতে ঘূর্ণিঝড় জলোচ্ছ্বাসের জন্য অপেক্ষা করতে হবে না। সামান্য বৃষ্টি কিংবা বড় কোনো জোয়ার এলেও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বাড়বে। এখনি যদি কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করে পরিবেশ বিপর্যয়  রক্ষা করতে না পারে তাহলে দ্বীপটির অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে পড়বে।

এ বিষয়ে বিশিষ্ট সমুদ্র বিজ্ঞানী, বাংলাদেশ ওশানোগ্রাফিক রিসার্চ ইনস্টিটিউট-ব্যুরোর মহাপরিচালক ও সরকারের অতিরিক্ত সচিব সাঈদ মাহমুদ বেলাল হায়দার জাগো কণ্ঠকে বলেন, ‘গত একশ বছরেও সেন্ট মার্টিন দ্বীপে কোনো প্রলয়ংকারি ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানেনি। তবে এখন এ ধরনের দুর্যোগে দ্বীপ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কেয়াবন দ্বীপের রক্ষা দেয়াল হিসাবে কাজ করে। বালির বন্ধন তৈরি, মাটির ক্ষয়রোধ ও সামুদ্রিক বাতাসের তীব্র প্রবাহ ঠেকাতে ভূমিকার কারণে উপকূলীয় অঞ্চল সুরক্ষায় কেয়াগাছের গুরুত্ব পরিবেশ বিজ্ঞানে অপরিসীম। এই কেয়াবন ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের কবল থেকে দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপটির জনবসতি রক্ষা করে। কেয়াবন উজাড় করলে দ্বীপকে রক্ষা করা সম্ভব না। যদি এভাবেই ধ্বংস করা হয় দ্বীপটি একদিন তলিয়ে যাবার আশঙ্কা রয়েছে।

ঘূর্ণিঝড় মোখার তাণ্ডবে সেন্ট মার্টিনেই ক্ষতি হয়েছে ১২০০ ঘরবাড়ি। এছাড়া অসংখ্য গাছপালা উপড়ে গেছে। প্রচণ্ড গতির বাতাস নিয়ে ১৪ মে বিকেল ৩টার দিকে কক্সবাজার ও মিয়ানমার উপকূলে আঘাত হেনেছে ঘূর্ণিঝড় মোখা।

সেন্ট মার্টিনে ঘূর্নিঝড় মোখায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের মাঝে ত্রাণ তৎপরতা শুরু করেছে জেলা প্রশাসন। সেন্ট মার্টিনের ক্ষতিগ্রস্ত ১২শ ঘর ঘরবাড়ির মেরামতে ঢেউটিন, অর্থ সহায়তা ও পুনর্বাসন কার্যক্রম শুরু করা হবে বলে জানিয়েছে।

জেলা প্রশাসক মুহাম্মদ শাহীন ইমরান জাগো কণ্ঠকে বলেন, আমরা সেন্ট মার্টিন ক্ষতিগ্রস্ত বিভিন্ন এলাকা পরিদর্শন করেছি। দ্বীপ রক্ষায় নতুন করে গাছ লাগানো হবে এবং ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

আরও খবর: