অপরাধ

শরীয়তপুরের ইতালি পাঠানোর নামে প্রায় অর্ধ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে একটি প্রতারক চক্র

  জাগোকন্ঠ ১ অক্টোবর ২০২৩ , ৯:২৪ পূর্বাহ্ণ

সোহেল রানা, শরীয়তপুর প্রতিনিধি:

শরীয়তপুরের ভেদরগঞ্জে ইতালি নেয়ার প্রলোভন দেখিয়ে একাধিক ব্যাক্তির নিকট থেকে প্রায় অর্ধকোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ উঠেছে কামাল পারভেজ ওরফে এনামুল ও তার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে। কামাল পারভেজ ওরফে এনামুল ভেদরগঞ্জ উপজেলার রামভদ্রপুর ইউনিয়নের ৪ নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা ও মান্নান পারভেজ ওরফে মান্নান হাওলাদারের ছেলে।
সরজমিনে অনুসন্ধানে গিয়ে দেখা যায় মান্নান হাওলাদারের দুই ছেলে তিন মেয়ে।বড় ছেলে কামাল পারভেজ ওরফে এনামুল।দীর্ঘদিন যাবত ইতালিতে ছিলেন পরবর্তীতে পাড়ি জমান অস্ট্রিয়াতে বর্তমানে প্রতারক চক্রের মূল হোতা।তার স্ত্রী চাকুরী করেন মার্কেন্টাইল ব্যাংকের ভেদরগঞ্জ শাখায়। ছোট ছেলে হক সাহেব ওরফে সুমন ইতালি প্রবাসী।এক মেয়ে অস্ট্রিয়া প্রবাসী তার স্বামী সুমন ব্যাংকে চাকুরিজীবী।এনামুল নিজেকে পরিচয় দেন কথিত দুবাই বাংলা মাল্টিমিডিয়া ট্রাভেলস ভেদরগঞ্জ এর স্বাধিকারী ও প্রতিনিধি ।অথচ ভেদরগঞ্জ উপজেলার কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়নি দুবাই বাংলা মাল্টিমিডিয়া ট্রাভেলস অফিসের অস্তিত্ব।

এনামুল তার পরিবারের এই সকল সদস্যদের এবং ভুয়া ট্রাভেলস এর পরিচয় দিয়ে তার পিতা মান্নান হাওলাদারের যোগসাজশে শুরু করেন টাকা হাতিয়ে নেয়ার কাজ। বিগত প্রায় এক বছর যাবত ইতালি/ইউরোপ/কানাডা/সুইডেন নেওয়ার নামে তাদের এই প্রতারনার ফাঁদে পা দিয়েছেন একাধিক ব্যাক্তি।বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে লোকজনদেরকে ইতালি ইউরোপ কানাডা সুইডেন নেয়ার ব্যাপারে প্রলোভন দেখিয়ে প্রতারনার প্রাথমিক ফাঁদ পাতেন এনামুল।

পরবর্তীতে তার পিতার মাধ্যমে এবং নিজে কৌশলে হাতিয়ে নেন টাকা।চুক্তি অনুযায়ী বিদেশ পৌছানোর নির্দিষ্ট সময় পার হলে শুরু করেন নানান তালবাহানা।পরবর্তীতে ভুক্তভোগীদের বিভিন্ন অনিয়ম ভুল দেখিয়ে উল্টো দাবি করেন বড় অংকের ক্ষতিপূরন।যা স্থানীয় মাতব্বর রাজনৈতিক ব্যাক্তিবর্গ ও প্রভাবশালীদের মাধ্যমে চাপিয়ে দেয়া হয় ভুক্তভোগীর কাধে যাতে তারা আর পাওনা টাকা ফেরত চাইতে সাহস না পায়।তাতেও কাজ না হলে ভুক্তভোগীর পেছনে লেলিয়ে দেয়া হয় স্থানীয় সন্ত্রাসী বাহিনী।এভাবেই প্রতিনিয়ত চলছে ইউরোপ কানাডা সুইডেন পাঠানোর নামে প্রতারনা।

ভেদরগঞ্জের ভুক্তভোগী রাকিব সরদার জাগোকণ্ঠ’কে জানান, ভেদরগঞ্জ বাজারের এস আই মার্কেটের কাপড়ের দোকান আক্তার সরদার ও মার্কেট মালিকের ছেলে জাহিদুল ইসলাম টিপু বেপারীর মাধ্যমে পরিচয় হয় এনামুল এর সাথে।এনামুল নিজেকে পরিচয় দেন দুবাই বাংলা মাল্টিমিডিয়া ট্রাভেলস এর স্বাধিকারী/প্রতিনিধি আবার কখনো পরিচয় দেন পারভেজ গ্রুপ ও ইনস্টিটিউট এর প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ।দীর্ঘদিন যাবত ছিলেন ইতালিতে। তার আপন ভাই ইতালি ও এক বোন অস্ট্রিয়া প্রবাসী।এনামুল ইতালি কানাডা সুইডেন বিভিন্ন দেশে লোক পাঠানোর ব্যবসা করেন।চার মাসের মধ্যে ইতালি পৌছে দিতে পারবে বলে নিশ্চয়তা দেন আমার পরিবারকে।আমার পরিবার তার সাথে স্টাম্পে লিখিত চুক্তি করেন।চুক্তির শর্ত অনুযায়ী চার মাসের মধ্যে ইতালি পৌছে দেবে এনামুল আর যদি পৌছাতে না পারে তাহলে সে অথবা তার অনুপস্থিতে তার পিতা মান্নান হাওলাদার চুক্তির সম্পূর্ণ টাকা ফেরত দিতে বাধ্য থাকিবে।

চুক্তি অনুযায়ী এনামুল ও তার পিতা মান্নান হাওলার আমার পরিবারের নিকট থেকে একাকালিন নগদ আট লক্ষ টাকা বুঝিয়া নেন।এরপর আরো কয়েক ধাপে পাঁচ লক্ষ টাকা নেয় এনামুল।ইতালি যাওয়ার জন্য মোট তের লক্ষ টাকা আমাদের কাছ থেকে নেয় তারা।চুক্তির শর্ত অনুযায়ী ৫ ডিসেম্বর ২০২২ ইং তারিখে প্রথমে আমাকে ডুবাই নেয়া হয়।ডুবাইতে কিছুদিন রাখার পর।সে আমাকে ইথুপিয়া পাঠানোর উদ্দেশ্য এয়ারপোর্টে পাঠায় সেখানে কাগজ পত্রের ত্রুটির কারনে আমাকে দুই দিন এয়ারপোর্টের ভিতরে থাকতে হয়।তার কিছুদিন পর ১৮ মে ২০২৩ তারিখে আমাকে বাংলাদেশে পাঠানো হয়। বলা হয় বাংলাদেশে গিয়ে তিনদিন থাকো ওখান থেকে তোমার ইতালির ফ্লাই হবে।তিনদিন পরে আমাকে নেয়ার আর কোন খবর নাই।সে কোন যোগাযোগ করে না।তার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও তাকে পাওয়া যায় না।পরবর্তীতে আমি বিষয়টি তার এলাকার মেম্বার চেয়ারম্যান গন্যমান্য ব্যাক্তিদের জানালে।বিষয়টি সমাধানে সকলেই ব্যার্থ হয় এবং আইনি পদক্ষেপ গ্রহনে পরামর্শ দেন।আমার পরিবার অনেক কষ্টে ধার দেনা করে এনামুলকে তের লক্ষ টাকা দিয়েছে।এখন সে নানা তালবাহানা ফন্দি শুরু করছে টাকা না দেয়ার।আমি আমার টাকা দ্রুত ফেরত পেতে চাই।আমি ডুবাই থাকতে জানতে পারি আমার মতো আরো তিনজনের কাছ থেকে একি কায়দায় হাতিয়ে নিয়েছে বিপুল অংকের টাকা।আমি চাই আর কেউ যেন আমার মত বিপদে না পরে সবাইকে সচেতন করতে চাই পাশাপাশি প্রশাসনকে বিষয়টি খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেয়ার অনুরোধ জানাই।নয়তো আমার মতো আরো অনেকের জীবন পরিবার ধংস হয়ে যাবে এই চক্রের প্রতারনার ফাঁদে।

ভেদরগঞ্জের আরেক ভুক্তভোগী জাহিদুল ইসলাম জানান,রাকিব সরদারের মত তিনিও প্রতারনার স্বীকার। একি পন্থা অবলম্বন করে তাকে চার মাসের মধ্যে ইতালি নেয়ার কথা বলে তার পরিবারের কাছ থেকে প্রায় আট লক্ষ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে প্রতারক এনামুল ও তার পিতা মান্নান হাওলাদার।বর্তমানে এনামুল দেশে নেই।তার পিতা থাকলেও তিনি বিষয়টি সম্পর্কে কোনো কর্নপাত করছেন না।যদিও চুক্তি অনুযায়ী এনামুলের অবর্তমানে তার পিতার এই টাকা পরিশোধ করার কথা।স্থানীয় সালিশরাও এ বিষয়টি সমাধান করতে ব্যার্থ হয়েছে।আমি আমার টাকা ফেরত চাই।

ভেদরগঞ্জের বাসিন্দা বীর মুক্তিযুদ্ধা হাজ্বী এলাহি বক্স বেপারী জাগোকণ্ঠকে জানান,রাকিব সরদার এবং জাহিদুল ইসলাম দুজনের পরিবার আমার সম্মুখে ভেদরগঞ্জ বাজারে বসে এনামুল ও তার পিতা মান্নান হাওলাদারের সাথে ইতালি যাওয়ার ব্যাপারে টাকা লেনদেন করেন।আমি তাদের চুক্তিনামায় সাক্ষী হিসেবে সহি করি। তাছাড়া আরো লোকজন সেসময় উপস্থিত ছিলো।এনামুল ও তার পিতা কাজটা ভালো করেনি। তাদের উচিত টাকাগুলো দ্রুত ফেরত দেয়া।

ভেদরগঞ্জ এস আই মার্কেটের সাবেক দোকাদার বর্তমানে ইাতলি প্রবাসী আক্তার সরদারের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান,আমি তখন দেশে ছিলাম।জাহিদুল ইসলাম আমার দোকান মালিকের ছেলে।জাহিদুল এবং রাকিব সরদারের সাথে এনামুল এবং মান্নান হাওলাদারের আর্থিক লেনদেনের সময় আমি সেখানেই উপস্থিত ছিলাম।আমি চুক্তিনামায় সাক্ষীও দিয়েছি।তার দুজন আমাদের সামনে তাদের পরিবারের কাছ থেকে টাকা গুলো নিয়েছে।

ভেদরগঞ্জ এস আই মার্কেটের বর্তমান হার্ডওয়্যার এর দোকানদার,আক্তার হোসাইন রাজু জানান,টাকা লেনদেনের সময় তিনি উপস্থিত ছিলেন।তাছাড়া আরও অনেক লোক উপস্থিত ছিলো।সবার সম্মুখে এনামুল ও তার পিতা মন্নান হাওলাদার তাদের কাছ থেকে টাকা নেয়।

রামভদ্রপুর ইউনিয়নের ৪ নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা এবং মুদি ব্যাবসায়ী আকবর শেঠ জানান,তার ছেলেকে ইতালি নেয়ার প্রলোভন দেখান এনামুল।প্রলোভনের প্রেক্ষিতে তার কাছে পাসপোর্ট টাকা জমা দেন।কিন্তু কয়েকদিন পরে জানতে পারেন সে প্রতারক চক্রের সক্রিয় হোতা।তাই তার কেছ থেকে পাসপোর্ট এবং টাকা ফেরত নিয়ে আসেন।

স্থানীয় মেম্বার জানান,আমরা শুনেছি এনামুল ও তার পিতা মান্নান হাওলাদার পাঁচ জনের কাছ থেকে বিপুল অংকের টাকা হাতিয়ে নিয়েছে ইতালি পাঠানোর নামে।তাদের মধ্যে দুই জন আমাদের কাছে বিচারও দিয়েছে।তাছাড়া আমার এক আত্মীয়ের কাছ থেকে বিদেশ পাঠানোর কথা বলে এক লক্ষ পঞ্চাশ টাকা নিয়েছে এনামুল।সে টাকাও উঠাতে পারছি না।

সালিসে উপস্থিত থাকা রামভদ্রপুরের আসলাম হাওলাদার জানান,আমরা বিষয়টি নিয়ে সালিসে বসেছিলাম। মান্নান হাওলাদার বিষয়টি প্রথমে স্বীকার করেন নি।পরবর্তীতে টাকা নেওয়ার বিষয় স্বীকার করেন।কিন্তু তিনি বলেন টাকা আমি নেই নি এনামুল নিয়েছে।আমি টাকা ফিরত দিব কিভাবে।
এবিষয়ে কামাল পারভেজ ওরফে এনামুল এর সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে জানা যায় বর্তমানে তিনি ডুবাই রয়েছেন।তার হোয়াটসএপে যোগাযোগ করা হলে তিনি কল রিসিভ করেননি।

আরও খবর: